প্রশাসনের সহযোগিতায় নির্বাচনী আচরণ বিধিমালা ভঙ্গ করলেন বিএনপি

নির্বাচন কমিশন কর্তৃক জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই সকল রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর জন্য নির্বাচনী আচরণবিধি কার্যকর হয়। এই আচরণবিধির মূল উদ্দেশ্য হলো নির্বাচনী পরিবেশে সমান সুযোগ (Level Playing Field) নিশ্চিত করা এবং সাধারণ জনগণের জানমাল ও চলাচলের নিরাপত্তা বজায় রাখা।
কিন্তু তফসিল ঘোষণার পরপরই রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক-মহাসড়কে বিএনপির একাধিক কর্মসূচি ও শোডাউনের মাধ্যমে আচরণবিধির একাধিক ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। এসব কর্মকাণ্ডের ফলে রাজধানীজুড়ে ভয়াবহ যানজট, জনদুর্ভোগ এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হয় বলে অভিযোগ করছেন ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ।

অভিযোগ রয়েছে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলীয় প্রতীক ‘ধানের শীষ’-সংবলিত স্টিকার লাগানো বুলেটপ্রুফ বাসে করে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর প্রটোকলে চলাচল করে নির্বাচনী শোডাউনে অংশ নেন। তফসিল ঘোষণার পর রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে এ ধরনের কর্মকাণ্ড নির্বাচনী আচরণবিধির “লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড” নীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বলে মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।

একই সঙ্গে অভিযোগ উঠেছে, গতকাল থেকেই সারাদেশ থেকে নেতাকর্মীদের ঢাকায় এনে পরিকল্পিতভাবে এই শোডাউন আয়োজন করা হয়েছে এবং ঢাকা শহরজুড়ে বিএনপির ব্যানার-ফেস্টুন লাগানো হয়েছে, যা তফসিল ঘোষণার পর সম্পূর্ণ বেআইনি।

নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী, প্রতীক বরাদ্দের পূর্বে কোনো প্রার্থী বা রাজনৈতিক দল মিছিল, শোডাউন, জনসভা বা গণজমায়েত করতে পারে না। অথচ তফসিল ঘোষণার পরপরই বিএনপির পক্ষ থেকে রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী নিয়ে বিশাল সমাবেশ ও শোডাউন আয়োজন করা হয়, যা আচরণবিধির সরাসরি পরিপন্থী বলে সংশ্লিষ্ট মহলের অভিযোগ।

বিএনপি নেতাকর্মীদের বহনকারী অসংখ্য বাস,যানবাহনের চাপে মহাখালী থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত সড়ক সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ একাধিক স্থানে যান চলাচল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়।
যানজটের কারণে হাতে টিকিট থাকা সত্ত্বেও বহু যাত্রী সময়মতো বিমানবন্দরে পৌঁছাতে পারেননি। ফলে একাধিক যাত্রীর ফ্লাইট মিস হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়।

তারেক রহমান তার বাবার মাজার জিয়ারতের উদ্দেশ্যে বের হলে মিরপুরের পল্লবী, রূপনগরসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার নেতাকর্মীদের দলীয় ব্যানার নিয়ে গুলশানের সড়কে অবস্থান নিতে দেখা যায়। এতে গুরুত্বপূর্ণ সড়কে যান চলাচলে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।
অভ্যন্তরীণ দলীয় নির্দেশনা অনুযায়ী, তারেক রহমান যেদিক দিয়ে যাবেন সেদিকের রাস্তার দুই ধারে ঢাকার বিভিন্ন ইউনিটের নেতাকর্মীদের দাঁড়িয়ে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে পরবর্তীতে প্রচারণা চালানো হয় যে, সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে।

গাবতলী থেকে সাভার স্মৃতিসৌধ পর্যন্ত মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে নেতাকর্মী রাস্তার ওপর অবস্থান নিয়ে শ্লোগান ও শোডাউন করায় যানবাহন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে ঢাকা–আরিচা মহাসড়কে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়।
উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গগামী কয়েকশ যাত্রীবাহী বাস ও পণ্যবাহী ট্রাক ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকে। যানজটের কারণে একাধিক অ্যাম্বুলেন্সকে সাইরেন বাজিয়ে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। সাভার ও নবীনগর এলাকায় জরুরি চিকিৎসাপ্রার্থী সাধারণ মানুষ চরম বিপাকে পড়েন।

কোনো যানবাহন এগোতে না পারায় নারী, শিশু ও বৃদ্ধসহ সাধারণ যাত্রীদের কয়েক কিলোমিটার পথ হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়। অনেক জায়গায় সড়কের ডিভাইডারের ওপর উঠে নেতাকর্মীদের অবস্থান এবং উল্টো পথে মোটরসাইকেল চালানোর কারণে ট্রাফিক পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়।
রাতের অন্ধকারে মহাসড়কের ওপর জনসমাগম এবং গাড়িবহরকে ঘিরে হুড়োহুড়ি বড় ধরনের দুর্ঘটনা ও নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করে বলে অভিযোগ উঠেছে।

নির্বাচনী আচরণবিধিতে স্পষ্টভাবে বলা আছে, জনচলাচলের পথ বন্ধ করে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি করা যাবে না। আজকের এই সড়ক অবরোধ সেই বিধির সরাসরি লঙ্ঘন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, তফসিল ঘোষণার পর এ ধরনের বিশাল জনসমাগম ও শোডাউন নির্বাচনী পরিবেশকে প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। নির্বাচন কমিশন চাইলে বিষয়টিকে “লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড” নষ্ট করার উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্ট দল বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ, জরিমানা কিংবা অন্যান্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে।

বারবার নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠার পরও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া ও বিভিন্ন মহলে সাধারণ জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ পাচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা ও কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত না হলে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে জনআস্থার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *