দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতে একের পর এক ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সংগঠনের চরম ব্যর্থতা ও পরাজয়ের পর নতুন নেতৃত্ব ও কমিটির দাবি দিন দিন জোরালো হচ্ছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলে। এর বাইরে কমিটিতে স্থান না পাওয়া পদ বঞ্চিত ও পদ প্রত্যাশীরা শুরু করেছেন আন্দোলন। ইতিমধ্যে তারা কয়েকবার নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আন্দোলন-বিক্ষোভ করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) পর জাকসু-চাকসু ও রাকসু নির্বাচন। একের পর এক ভরাডুবি। চার চারটি বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনে বিএনপির আন্দোলনের প্রধান ‘ভ্যানগার্ড’ হিসেবে পরিচিত জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ফলাফল রীতিমতো লজ্জার। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদে ছাত্রদলের এমন ভূমিধস পরাজয় বিএনপিকে রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে। সিদ্ধান্ত নিতে পারদর্শী তরুণ ছাত্রসমাজের কাছে এক সময়ের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল; সেই ছাত্রদলের অগ্রহণযোগ্যতা নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলেও মনে করছে দলটি। যদিও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন জোর দিয়ে বলেছেন, ডাকসু, জাকসু, চাকসু ও রাকসুর ছাত্রসংসদের নির্বাচনী ফল জাতীয় নির্বাচন বা রাজনীতিতে কোনো প্রভাব ফেলবে না।
ছাত্রদল সূত্র জানায়, পরাজয়ের নেপথ্য কারণ নিয়ে চলছে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। বিএনপির নেতারা এ লজ্জাজনক পরাজয়ের কারণগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। নেতৃত্বের কোন্দল, অছাত্রদের হাতে ছাত্রদলের নেতৃত্ব ও তুলনামূলক বেশি বয়সী নেতৃত্বের কারণে তরুণদের মনোভাব বুঝতে অক্ষমতা চিহ্নিত হয়েছে। আর বর্তমান ব্যর্থ নেতৃত্বকে সরিয়ে খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে ছাত্রদলের নতুন কমিটি দেয়ার কথা ভাবছেন বিএনপির হাইকমান্ড।
২০২৪ সালের ১ মার্চ মো. রাকিবুল ইসলাম রাকিবকে সভাপতি ও নাছির উদ্দীন নাছিরকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। ওই বছরের ১৫ জুন ছাত্রদলের ২৬০ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি অনুমোদন করা হয়। এরপর নতুন করে আরও দুজন সহ-দপ্তর সম্পাদকের পদ বাড়ানো হয়। তাতে কমিটির কলেবর বেড়ে দাঁড়ায় মোট ২৬২ জনে।
সূত্র জানায়, নেতৃত্বের কোন্দলের কারণে এলোমেলো হয়ে পড়েছে ছাত্রদল। তাছাড়া দলীয়ভাবে ছাত্রদল দেখভাল করার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল নিজেই সংগঠনে প্রভাব ধরে রাখার জন্য নিজস্ব বলয় তৈরি করেছেন বলে সংগঠনটিতে অভিযোগ রয়েছে। আর নিজস্ব বলয় তৈরি করতে গিয়ে ছাত্রদলকে তিনি এক ধরনের জিম্মি করে রেখেছেন বলেও অভিযোগ আছে। অবশ্য, এই নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলতে নারাজ বা সাহস করে উঠতে পারেন না। নেতাকর্মীদের অভিযোগ, বকুলের হাতে জিম্মি হওয়ার প্রতিফলনই হচ্ছে সাম্প্রতিক ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ফল।
ছাত্রদল সূত্রে জানা যায়, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতে একের পর এক ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সংগঠনের চরম ব্যর্থতা ও পরাজয়ের পর নতুন নেতৃত্ব ও কমিটির দাবি দিন দিন জোরালো হচ্ছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলে। এর বাইরে কমিটিতে স্থান না পাওয়া পদ বঞ্চিত ও পদ প্রত্যাশীরা শুরু করেছেন আন্দোলন। ইতিমধ্যে তারা কয়েকবার নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আন্দোলন-বিক্ষোভ করেছে। সর্বশেষ কাফন মিছিলও করেছে।
তবে, বর্তমান কমিটি তাদের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে পদ বঞ্চিত ও পদ প্রত্যাশীদের কমিটিতে স্থান দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। যাতে করে তাদের আন্দোলন থেমে যায়। সেজন্য ইতিমধ্যে বিভিন্ন গ্রুপ থেকে পদ প্রত্যাশীদের তালিকাও নেয়া হয়েছে। যে কোনো সময় সেই তালিকা থেকে পদ দিয়ে কমিটির কলেবর বাড়িয়ে প্রায় ৪ থেকে সাড়ে ৪’শ করতে চায় রাকিব-নাছির কমিটি।
ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা জানান, ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলেও ছাত্রদল ক্যাম্পাসে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে পারেনি। কারণ হচ্ছে সাংগঠনিক দুর্বলতা। যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল তারা যোগ্যদের নেতৃত্বে না এনে নিজ গ্রুপের বা বলয়ের লোকদের হাতে নেতৃত্ব তুলে দেয়া হয়েছে। ফলে তৈরি হয় দ্বন্দ্ব-কোন্দল, বিভক্ত হয় ছাত্রদল। আর এ বিশৃঙ্খলার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছেন বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল এমন অভিযোগ নেতাকর্মীদের। তাদের দাবি, এ গ্রুপিংয়ের রাজনীতির কারণে সংগঠনটি ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ভালো করতে পারেনি।
‘ডাকসু, জাকসু, রাকসু, চাকসুর টানা ব্যর্থতার পর বর্তমান নেতৃত্ব তাদের নেতৃত্বে থাকার নৈতিকভাবে অধিকার হারিয়েছেন। এসব নির্বাচনের পরপরই তাদের কমিটি থেকে পদত্যাগ করা উচিত ছিল। তাছাড়া, বয়সের কারণে তারা ছাত্রদের পালস ধরতে পারছেন না। ছাত্রদের মনের কথা বুঝতে পারছেন না। সে কারণে ছাত্রদলের মতো স্মার্ট সংগঠন বর্তমানে মুখ থুবড়ে পড়েছে।’
একাধিক নেতা জানান, ছাত্রদলের সাংগঠনিক অভিভাবক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ডাকসু নির্বাচনে দলীয় ব্যানারে যেতে চাননি। কারণ দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর বিএনপির ক্ষমতার বাইরে ছিল। এছাড়া নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের গুন্ডামির কারণে ছাত্রদলও ক্যাম্পাসে রাজনীতি করতে পারেনি। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এসব কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ ছিল না ছাত্রদলের। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থী শিক্ষকরাও সংগঠনের ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নিতে নিরুৎসাহিত করেন। কিন্তু সবার মতামত উপেক্ষা করে রকিবুল ইসলাম বকুলের একক সিদ্ধান্তে ডাকসু নির্বাচনে অংশ নেয় ছাত্রদল। এখানেই শেষ নয়, পছন্দমতো প্রার্থী দিতে না পারায় নির্বাচনের সময় তার ভূমিকাও ছিল রহস্যজনক।
সূত্র জানায়, বকুলের পছন্দের প্রার্থী হিসেবে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছিরের নাম শোনা যায়। নাছিরকে ডাকসুতে প্রার্থী করতে না পেরে তিনি ক্ষুব্ধ হন। যে কারণে তিনি নির্বাচনের সময় নিষ্ক্রিয় থাকেন এবং শারীরিক অসুস্থতার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হন। ডাকসুর পর জাকসু নির্বাচনের পরদিনই নয়া পল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সাত নেতাকে ডাকেন তারেক রহমান। মিটিংয়ে অংশ নেন বিএনপি ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ড. মাহদী আমিন এবং ছাত্রদলের সুপার ফাইভের নেতারা।
ওই বৈঠকে উপস্থিত এক নেতা জানান, ওই বৈঠকের পরই ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন কমিটি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আবারও সেই ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক নানা অজুহাতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নতুন কমিটি গঠন না করার অনুরোধ জানান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে। যে কারণে নতুন নেতৃত্ব পাওয়ার বিষয়টি ঝুলে যায় ছাত্রদলের।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুলের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সফল হওয়া যায়নি। তার মুঠোফোন নম্বরে বার্তা পাঠালেও তিনি কোনো রেসপন্স করেননি।
